শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস। বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন।
শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে এক সংক্ষিপ্ত সভায় ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মো. হেলাল উদ্দিন ভাষা আন্দোলনের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে দুই অঞ্চলের মধ্যে অসম অর্থনীতি ছাড়াও জাতিগত, প্রকৃতিগত, সংস্কৃতিগত এবং ইতিহাসের স্বতন্ত্র সত্তাগুলি ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল উপনিবেশিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনা ও নির্যাতনের এক করুন ইতিহাস। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সর্বপ্রথম পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সংঘাতের সূচনা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাকে উপেক্ষা করে জিন্নাহ একুশে মার্চের জনসভায় এবং ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভাষার উপর আঘাত হানে এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়। জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে উপস্থিত ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। সেদিন জিন্নাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের নিকট থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনরায় ঘোষণা দিলে এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠনের দিন যুবলীগ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সম্বলিত প্রস্তাব সমর্থন করে এবং পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশ্যে আবেদিত বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে। প্রদেশব্যাপী হরতাল, ধর্মঘট ও ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ২০ শে ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ২১ তারিখে ঢাকার ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং প্রতিবাদ মিছিল বের করে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী ছাত্রদের উপর গুলি চালায় ফলে বহু ছাত্র জনতা আহত এবং শহীদ হয়। শহীদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত, সালাম এবং রফিকসহ অনেকে ছিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ ধর্মঘট পালিত হয়। সমগ্র প্রদেশব্যাপী মাতৃভাষার দাবিতে সর্বত্র গণবিক্ষোভ চলতে থাকে। বহু ছাত্র, শিক্ষক, জননেতা গ্রেফতার হন। সর্বত্র ধরপাকড় শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে, তারা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন পুনরায় বিবেচনা করে দেখবেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম গণসচেতনার সুসংগঠিত সফল গণ-অভ্যুত্থান ও পরবর্তীকালে শাসক চক্রের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
ভাষা আন্দোলনের ফলে জাগ্রত জাতীয়তাবাদী চেতনাই পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে উল্লেখ করে শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেসের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানদের সঙ্গে একীভূত হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়। ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানি বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাকিস্তান সরকার বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।