১৮ ফেব্রুয়ারি।। ২০২৪
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। ১৯৬৯ সালের এই দিনে পাকিস্তান সামরিক সরকারের সেনাবাহিনী বুলেটের আঘাতে তৎকালিন দায়িত্বরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে। তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকারের হাতে নিহত প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামক দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ মুসলিম অংশের সাথে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম জনগণের সাথে একীভূত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করলে হিন্দুরা এর বিরোধিতা করে। ফলে মুসলমানরা বুঝতে পেরেছিল, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন সেই প্রত্যাশা তাদের পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কেননা শুরু থেকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান তাদের যৌক্তিক দাবি ব্রিটিশ সরকারের নিকট পেশ করবে।
কিন্তু ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলে তা মুসলমানদের হতাশ করে। ফলে মুসলমানরা নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে মুসলিম লীগ নামক একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করেন। ফলে ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করলে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সাম্প্রদায়িকতার রূপ পরিলক্ষিত হয় এবং আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯১১ সালে তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে বাধ্য করে।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা ও ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যে অবিশ্বাস অনাস্থা ও সাংঘর্ষিক মনোভাব তৈরি হয়, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের সাথে একত্রিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং হিন্দুরা ভারত নামক রাষ্ট্র গঠন করে।
কিন্তু পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একীভূত হয়েছিল অচিরেই তার স্বপ্নভঙ্গ ঘটে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
ভাষা আন্দোলন ছিল পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র আন্দোলন যে আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জীবন দিতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, শাসন, জুলুম ও নির্যাতনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে পাকিস্তান বিরোধি মনোভাব জাগ্রত হয় এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবল হয়। পূর্ব পাকিস্তানিদের এই জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও প্রসারিত হয় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সামরিক শাসন জারি করা হলে। জান্তা সরকার কর্তৃক সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং EBDO & PODO এর মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযোগে কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে বন্দী করা হয়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সামরিক শাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হলে পূর্ব বাংলার ছাত্র সংগঠনগুলো সীমিতভাবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পাকিস্তানি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
ছাত্র সংগঠন কর্তৃক ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন পাকিস্তান জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সংগঠন কর্তৃক শরীফ শিক্ষা কামিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনেক শিক্ষা লাভ করেন। তৎকালিন ডাকসু নির্বাচনে পাকিস্তান পন্থী ছাত্র সংগঠনের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংগঠনের বিজয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান সরকার বিরোধি আন্দোলনের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। সেই সাথে ছাত্র সংগঠনের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সামরিক সরকার সীমিত আকারে রাজনৈতিক কর্মকান্ড ঘোষণা করে। ফলে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধি প্রার্থী হিসেবে মিসেস ফাতেমা জিন্নাহ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং জান্তা সরকারের অপ-প্রচার, জুলুম-নির্যাতন ও পেশিশক্তির নিকট মিস ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হন।
পাকিস্তান সরকারের ধারাবাহিক বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি ব্যাপক সমর্থন প্রকাশ করেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলন উভয় অংশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান সরকার বিরোধি আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পাকিস্তান সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে মিথ্যা মামলা ঘোষণা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা এতই বৃদ্ধি পায় যে, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি, শ্রমিক ও মেহনতি জনগণ পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। শুরু হয় সমগ্র পূর্ব বাংলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক সামরিক শাসন বিরোধি ছাত্র আন্দোলন।
১৯৬৯ সালের শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে রাজপথে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে শিক্ষার্থীদের রক্ষার জন্য ড. শামসুজ্জোহা এ উক্তি করেছিলেন যে, ‘কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে গুলি লাগবে আমার বুকে।’ শিক্ষার্থীবান্ধব ও ছাত্রদের জীবন রক্ষায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শিক্ষকের সেই অমোঘ বাণিই সত্যি হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকাল ১১.০০ ঘটিকায়। ঐ দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সম্মুখে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বুলেটের আঘাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে তাঁরই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে। রক্তাক্ত বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাঁসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা ড. শামসুজ্জোহা স্যারকে মৃত ঘোষণা করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আজও আমাদের হৃদয়ে জাগরুক হয়ে থাকবেন।
ড. শামসুজ্জোহা স্যারের হত্যাকান্ডের ফলে সমগ্র দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ঢাকাসহ সমগ্র বাংলায় ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক-জনতা ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী এই আন্দোলনের তীব্রতা দেখে পাকিস্তান জান্তা সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যতম আসামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের এই গণ-অভ্যুত্থান বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার সূত্রপাত ঘটেছিল ড. জোহা স্যারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ড. শামসুজ্জোহা স্যারের হত্যাকান্ড ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম উপলক্ষ হিসেবে কাজ করেছিল।
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহা স্যারের হত্যাকান্ডের ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও বাংলাদেশ সরকার এই দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেননি। প্রতিবছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয় এবং এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাশ ও অফিস বদ্ধ থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানানো হলে আজ পর্যন্ত সরকারিভাবে এ বিষয়ে কোন স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।
এই দিবসকে স্মরণ করার লক্ষ্যে এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহা’র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের নিমিত্তে শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস কর্তৃক শোক র্যালির আয়োজন করা হয় এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহা’র সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। উক্ত শোক র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্সেস এর প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব মোঃ হেলাল উদ্দিন, উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারিবৃন্দ।